অর্থ ও বাণিজ্য

ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ছে না, বাড়বে খেলাপি ঋণ

Share
Share

ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে এক বছর মুক্ত থাকার পর ব্যবসায়ীদের এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে খেলাপি ঋণের সময় গণনা শুরু হচ্ছে। যদিও ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর দাবি ছিল এফবিসিসিআইসহ দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি নাকচ করে মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরইমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আগামী জুলাই মাসের পর থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, মার্চ থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশ ঋণ নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মতে, এখন এই সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপি ঋণের প্রভাব যেভাবে পড়বে, ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ব্যাংকগুলোতে ধাক্কা তার চেয়ে একটু কম লাগতো।

এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আব্দুস শহীদ বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো নিয়ে সরকারের একটি পলিসি আছে। সরকারের পলিসি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তিনি উল্লেখ করেন, কোভিড মোকাবিলায় ব্যবসায়ীদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সেই প্রণোদনায় সুদ হিসেবে অর্ধেক দিচ্ছে সরকার, বাকি অর্ধেক দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ফলে ব্যবসায়ীরা যদি আরও সুবিধা নিতে চান সেক্ষেত্রে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানাতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, কোভিডের কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর যে দাবি জানিয়েছেন তা যৌক্তিক। তবে এই সুযোগ ঢালাওভাবে সবাইকে দেওয়া উচিত নয়। তিনি জানান, করোনার কারণে গত ছয় সাত মাস ধরে কমিটির কোনও সভা হচ্ছে না। সভা হলে আমরা বলতে পারবো।

অবশ্য যেসব ব্যবসায়ী করোনাকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া জরুরি ছিল বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। আগের সুবিধা অব্যাহত না থাকায় ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাব ও ঋণ বকেয়া স্থিতির পরিমাণ বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কেবল মেয়াদি ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাবের অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ সময় বৃদ্ধি করা যাবে। তবে এরূপ বর্ধিত সময়সীমা কোনোভাবেই দুই বছরের বেশি হবে না।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিদায়ী বছরের এপ্রিল থেকে তিন দফায় ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

তবে ডিসেম্বরে তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই-এর সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, আর ছয়টা মাস বাড়ানো গেলে ভালো হতো। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও ঠিক হয়নি। যদি সময় বাড়ানো না হয়, তাহলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আর ব্যবসায়ীরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন সেক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা না বাড়ানো হলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। ভালো ভালো ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে পড়বেন। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, একদিকে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও বাঁচাতে হবে। আর এটি করতে হলে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ডেফারেল সুবিধা নেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ঋণগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি ডেফারেল সুবিধা নিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক থেকে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক থেকে কোনও অর্থই আদায় হয়নি। এছাড়া গ্রাহকদের বেশি ডেফারেল সুবিধা দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাচ-বাংলা, সোনালী, আইএফআইসি, সাউথইস্ট, জনতা, ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। এসব ব্যাংক থেকেই গ্রাহকরা ডেফারেল সুবিধা পেয়েছেন ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles
অর্থ ও বাণিজ্যসর্বশেষ

বেক্সিমকোর ১৬ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, ব্যাংক ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা

বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বেক্সিমকো লিমিটেডের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে...

অর্থ ও বাণিজ্যসর্বশেষ

পণ্য খালাসে বিলম্ব এড়াতে সাময়িক ছাড়পত্র দেবে বিএসটিআই

আমদানি করা শিল্পের কাঁচামাল খালাসে বিলম্ব এড়াতে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত...

অর্থ ও বাণিজ্যসর্বশেষ

ফোনে কথা বলা, রেস্তোরাঁ, পোশাকে ভ্যাট কমানোর আদেশ জারি

ভ্যাট বাড়ানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে কিছু পণ্য–সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমাল...

অর্থ ও বাণিজ্যকর্পোরেটজাতীয়ঢাকাসর্বশেষ

আশুলিয়ায় ২২ কারখানায় সাধারণ ছুটি

ঢাকার সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের অন্তত ২২টি পোশাক কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা...